সালাহউদ্দিন আইয়ুবির পরিচয়, চরিত্র, ও কৃতিত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।
প্রিয় পাঠক, আজকে আমরা আপনাদের মাঝে আরও একটি নতুন আর্টিকেল নিয়ে চলে এসেছি। আজকের আর্টিকেলের বিষয় হচ্ছে সালাউদ্দিন আইয়ুবির পরিচয়, চরিত্র, ও কৃতিত্ব নিয়ে আলোচনা করা হবে। আর আপনাদের এই আর্টিকেলটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য অনুরোধ জানানো হলো।
তা না হলে আপনাদের অনেক বিষয় না জানা থেকে যেতে পারে। যার ফলে আপনাদের আইয়ুবী বংশের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অজানা থেকে যাবে।
আইয়ুবি বংশ (১১৭৪-১২৫০)
ফাতেমি বংশের ধ্বংসস্তূপের ওপর ১১৭৪ খ্রিস্টাব্দে মিশর ও সিরিয়ায় তুর্কি আইয়ুবি বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবি। ইউরোপীয় ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে তিনি মুসলিম প্রতিরোধের নেতৃত্ব দেন। সালাউদ্দিনের পিতার নাম ছিল নাজমুদ্দিন আইয়ুব। তিনি সিরিয়ার শাসনকর্তা ইমাম উদ্দিন জঙ্গির একজন কর্মকর্তা ছিলেন। তার পুত্র সালাউদ্দিন আইয়ুবী ১১৭৪ খ্রিস্টাব্দে ফাতেমীয়দের পতনের পর মিশরে এক নতুন রাজ বংশের গোড়াপতন করেন।
পিতার নামানুসারে তিনি এর নামকরণ করেন “আইয়ুবি বংশ”। এ বংশের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মিশর। বারো ও তেরো শতকে রাজবংশ মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত। নিচে আইয়ুবী বংশের সকল শাসকদের নাম ও তাদের শাসনকাল সম্পর্কে একটি তালিকা দেওয়া হলো।
শাসকের নাম | শাসন কাল শুরু | শাসন কাল শেষ |
---|---|---|
সালাউদ্দিন | ১১৬৯ খ্রিষ্টাব্দ | ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দ |
আল-আজিজ ইমাদুদ্দিন | ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দ | ১১৯৮ খ্রিষ্টাব্দ |
আল-মনসুর মুহম্মদ | ১১৯৮ খ্রিষ্টাব্দ | ১১৯৯ খ্রিষ্টাব্দ |
সাইফুদ্দিন | ১১৯৯ খ্রিষ্টাব্দ | ১২১৮ খ্রিষ্টাব্দ |
আল-কামিল মুহম্মদ | ১২১৮ খ্রিষ্টাব্দ | ১২৩৮ খ্রিষ্টাব্দ |
আল-আদিল | ১২৩৮ খ্রিষ্টাব্দ | ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দ |
আল-সালিহ নাজমুদ্দিন | ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দ | ১২৪৯ খ্রিষ্টাব্দ |
আল মুয়াজ্জাম তুরান শাহ | ১২৪৯ খ্রিষ্টাব্দ | ১২৫০ খ্রিষ্টাব্দ |
সালাহউদ্দিন আইয়ুবির পরিচয়
সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ১১৩৭ সালে দজলা নদীর তীরে অবস্থিত তিকরিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ব্যক্তিগত নাম ইউসুফ। সালাউদ্দিন হল উপাধি, যার অর্থ বিশ্বাসের ন্যায়পরায়ণ। তিনি ছিলেন কুর্দি জাতির অন্তর্ভুক্ত এবং সুন্নি মতাদর্শের অনুসারী। তার বাবা ছিলেন কুর্তি নেতা আইয়ুব। যিনি আত আতাবেগ জঙ্গির অধীনে বালাবাক্কুর সেনাধ্যক্ষের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ১১৬৪ সালে পিতৃব্য শিরকুহের সাথে মিশর অভিযানে অংশগ্রহণ করেন।
এ যুদ্ধে জয়ী হলে শিরকুহ ফাতেমি খলিফা আল আজিজের উজিরের পদটি করায়ত্ত করে খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে শিরকুহের মৃত্যু হলে (১১৬৯ খ্রি.) সালাহউদ্দিন আইয়ুবি তার চাচার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি শাসন ক্ষমতায় বসে স্বাধীন রাজবংশের নৃপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা সহ যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেন সেগুলো তাকে ইসলামের ইতিহাসে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করে।
ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে তার সালতানাতে মিশর, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, হেজাজ, ইয়েমেন এবং উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইসলামের এই বীর সন্তান ১১৯৩ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৫৫ বছর বয়সে দামাস্কাসে মৃত্যুবরণ করেন।
চরিত্র
- মহানুভ: শাসক ও ব্যক্তি হিসেবে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি একজন মহান উদ্ভব শাসক ছিলেন। পি কে হিট্রি বলেন, সালাহউদ্দিন যেমন প্রবল পরাক্রমশালী ছিলেন, তেমনি বিনয়ী ছিলেন। তার বিনয় ও মহানুভবতার নিদর্শন পাওয়া যায় হিট্রিনের যুদ্ধের পর খ্রিস্টান শাসকদের সাথে সদ্য ব্যবহার ও তাদের মুক্তি প্রদানের ঘটনা থেকে এমনকি সালাহউদ্দিনের খ্রিস্টান শত্রুরাও তার উদারতা, মহানুভবতা ও বদান্যতার প্রশংসা করেছেন। তিনি নিজে ধার্মিক ছিলেন কিন্তু অপরের ধর্মানুভূতিকে সম্মান দেখাতে কার্পণ্য করেননি।
- জনকল্যাণকামী: সালাহউদ্দিন আইয়ুবি একজন জন কল্যাণ কামি শাসক ছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্মের সুন্নি মতাদর্শের বিকাশের সাথে সাথে শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং জনকল্যানেও নিয়োজিত ছিলেন। তিনি এ লক্ষ্যে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদ তৈরি করেন। তিনি বাঁধ নির্মাণ করেন এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করেন।
- বিদ্যানুরাগী: তিনি জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য গুণীজন ও শিক্ষিত ব্যক্তিদের যথাযথ মূল্যায়ন করতেন। তার মন্ত্রিসভার 2 উচ্চশিক্ষিত উজির আল কাজিম আল ফাজিল এবং ইমাদ আল-দ্বীন-আল-কাতিব-আল-ইসফাহানির নিয়োগ ও পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে তার জনকল্যাণকর কার্যাবলী পরিচয় মেলে।
কৃতিত্ব
- স্বাধীন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা: ১১৬৭ খ্রিস্টাব্দে মিশরের বিদ্রোহের সুযোগে চাচা শিরকুহের সাথে সালাহউদ্দিন মিশরে যান এবং যুদ্ধে শিরকুহ জয়ী হলে তিনি ফাতেমীয় উজিরের পদটি করায়ত্ত করে খলিফা পদে আশীন হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে শিরকুহের মৃত্যু হলে সালাহউদ্দিন ১১৬৯ খ্রিস্টাব্দে তার স্থলাভিষিক্ত হন। ১১৭৪ খ্রিস্টাব্দে নূরউদ্দিন জঙ্গির আনুগত্য পরিহার করে মিশরে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এভাবে তিনি স্বাধীন আইয়ুবি বংশের শাসনের সূচনা করেন।
- শাসনক্ষমতা সুদৃঢ়করণ: সালাহউদ্দিন আইয়ুবি একজন চৌকস শাসক হিসেবে সেনাবাহিনীর সংস্কার সাধন করেন এবং সেনাবাহিনী পরিচালনার জন্য যোগ্য সেনাপতি নিয়োগ দেন। তিনি এ লক্ষ্যে অর্থ-প্রশাসনও সুদৃঢ় করেন এবং বিশ্বস্ত কাজী আল ফাজিলকে এর কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দিলে রাজস্ব প্রশাসন ব্যবস্থাও সুদৃঢ় হয়।
- সুন্নি শাসনের প্রতিষ্ঠা: সালাউদ্দিন ১১৭১ খ্রিস্টাব্দে শুক্রবারের নামাজের খুতবা থেকে ফতেমি খলিফার নাম বাদ দেন এবং আব্বাসী খলিফার নাম যুক্ত করেন এবং খলিফা মুস্তাদির নিকট থেকে ১১৭৫ খ্রিস্টাব্দে মিসর, আল-মাগরিব, নুরিয়া, পশ্চিম আর, প্যালেস্টাইনের শাসকের সম্মান পান। আব্বাসীয় খলিফা সালাহউদ্দিনকে “ মালিক–আন-নাসির” উপাধি প্রদান করেন।
- বিদ্রোহ দমন: সালাহউদ্দিন আইয়ুবি নিজ শাসনকে সুদ দৃঢ় করার জন্য বিদ্রোহ দমনের দিকে নজর দেন। এজন্য তিনি নুরুদ্দিন জঙ্গির পুত্র ইসমাইলের বিরুদ্ধে অভিযান চালনা করেন এবং হাসায় জয়লাভ করে সমগ্র সিরিয়া হস্তগত করেন। এর ফলে আল হেজাজসহ অন্যান্য ধর্মীয় শহরগুলো মিশরের অধীনতা স্বীকার করে।
- গুপ্ত ঘাতকদের দমন: গুপ্ত ঘাতকরা তাকে দুইবার হত্যার চক্রান্ত করে ব্যর্থ হয়। ফলে তিনি ১১৭৬ খ্রিস্টাব্দে গুপ্তঘাতকদের নেতা রশিদ আল দিন স্নানের সদর দপ্তর শাসিয়াদ অবরোধ করলে গুপ্তঘাতকরা দমিত হয়।
- ফ্রাঙ্কদের বিরুদ্ধে অভিযান: পি কে হিট্রির মতে “মিসরে শিয়া সম্প্রদায়ের পরিবর্তে সন্নি শাসন প্রতিষ্ঠা এবং ধর্মযুদ্ধে ফ্রঙ্কদের প্রতিহত করা।” তাই গুপ্তঘাতকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পর তিনি নিশ্চিন্ত মনে ফ্রাঙ্কদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং ছয় দিন অবরোধের পর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে ১ জুলাই টিবোরিয়াশ দখল করেন।
- বল্ডুইনের বিরুদ্ধে অভিযান: ফ্রাঙ্কদের সাথে মুসলমানদের একটি শান্তি চুক্তি স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু ফ্রাঙ্করা শান্তি চুক্তির কথা ভুলে আরব ভূখন্ডে লুণ্ঠন শুরু করলে ফরাসি রাজা বল্ডুইন তাদের আশ্রয় দেয় এবং ফ্রাঙ্করা দামেস্ক ও তার আশেপাশে লুটতরাজ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী একটি শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে প্যালেস্টাইন আক্রমণ করে ফরাসি বাহিনীর হাতে পরাজিত হন।
- হিট্রিনের যুদ্ধ: ডিভোরিয়াস অধিকারের পর সালাহউদ্দিন আরও অগ্রসর হলে ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে তিন থেকে চার জুলাই ফ্রাঙ্ক অধিপতি শ্যাটিলনের রেজিল্যান্ডের সাথে বিখ্যাত হিট্রিনের যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এ যুদ্ধের ফ্রাঙ্ক বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং ২০ হাজারের মতো সৈন্যসহ শ্যাটিলনের রেজিল্যান্ড সালাহউদ্দিনের হাতে বন্দি হন।
- তৃতীয় ক্রুসেড: জেরুজালেমের পতন খ্রিস্টান জগৎ সহজে মেনে নিতে পারেনি তাই ইউরোপের সর্বত্র ধর্মীয় যুদ্ধোন্মাদনা ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ইউরোপের রাজন্যবর্গ নিজেদের মধ্যকার বিরোধ ও বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তৃতীয় ক্রুসেডের ডাক দেয়। খ্রিস্টানদের পক্ষে ক্রুসেডে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন তৎকালীন ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী তিন শাসক জার্মান সম্রাট ফ্রডরিক বারবারোসা, ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম রিচার্ড এবং ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ অগাস্টাস। পি কে হিট্রি বলেন, “এইভাবে শুরু হয় তৃতীয় ক্রুসেড।” সালাহউদ্দিন সাইপ্রাস দখল ও আরকা অবরোধের মধ্য দিয়ে ক্রুসেডারদের দমন করেন।
মূল্যায়ন
গাজী সালাউদ্দিন আইয়ুবী তার কার্যাবলীর দ্বারা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। আয়ুবি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা, রাজ্য, বিস্ত সুন, বিশেষ ক্র, খ্রিস্টানদের সাথে সদ্য ব্যবহার সহ বিভিন্ন কার্যাবলীর দ্বারা তিনি ইসলামের ইতিহাস ও ইউরোপীয় ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন।
শেষ কথা
প্রিয় পাঠক, আজকের এই আর্টিকেলটি পড়ার মাধ্যমে সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর পরিচয়সহ আরো বিভিন্ন সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। তাহলে এই আর্টিকেলটি ভালো লেগে থাকলে অবশ্যই আপনার বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করবেন। আর এই ধরনের আরো নিত্যনতুন আর্টিকেল পড়ার জন্য আমার ওয়েবসাইটটি ফলো করতে পারেন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url