খলিফা আবু জাফর আল মনসুরের পরিচয়, চরিত্র ও কৃতিত্ব নিয়ে আলোচনা।
আবু জাফর আল মনসুরের পরিচয়, চরিত্র ও কৃতিত্ব নিয়ে আজকেরে আটকেলে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। আপনারা আজকের এই আর্টিকেলটি পড়ার মাধ্যমে খলিফা আবু জাফর আল মনসুর এর জীবনীর বিভিন্ন বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে পারবেন। তাছাড়াও আজকের এই আর্টিকেলে আবু জাফর আল মনসুর এর পরিচয় চরিত্র ও কৃতিত্ব ছাড়াও বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
এজন্য আপনারা আজকের এই আর্টিকেলটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার চেষ্টা করবেন। তা না হলে আপনারা এখানে থাকা বিভিন্ন ধরনের তথ্য সম্পর্কে অজানা থেকে যাবে। তাহলে চলুন আর দেরি না করে আজকের এই আর্টিকেলটি শুরু করা যাক।
খলিফা আবু জাফর আল মুনসুর এর পরিচয়
আবুল আব্বাস আস-সাফফাহ মৃত্যু কালে ৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে তার ভ্রাতা আবু জাফরকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। এ সময় আবু জাফর মক্কায় অবস্থান করেছিলেন। কিন্তু ভাতার মৃত্যু সংবাদ শুনে তিনি দ্রুত কুফায় ফিরে আসেন এবং আল মনসুর বা বিজয়ী উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহন করেন।
তিনি দীর্ঘ একুশ বছরের শাসনামলে সাম্রাজ্যের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য যে সকল প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন তাই তাকে আব্বাসী বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আবু জাফর আল মনসুর দীর্ঘ ২১ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করে ৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে মক্কার নিকটবর্তী স্থানে মৃত্যুবরণ করেন।
খলিফা আবু জাফর আল মনসুর এর চরিত্র
আকৃতি ও ব্যক্তিত্ব: আল মনসুর দীর্ঘ দেহে, সাম্যবর্ণ, সুশ্রী চেহারার অধিকারী ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ধার্মিক, আশীর্বাদ, ন্যায়পরায়ন, পরিশ্রমী ও নির্মল চরিত্রের অধিকারী হলেও তার চরিত্রে কিছু দোষ গুণের সম্মেলন ঘটেছিল। একদিকে তিনি কখনো অশ্লীলতা, নৈতিক বিরোধী কাজকে যেমন প্রশ্রয় দেননি অন্যদিকে তিনি ছিলেন কপোট, বিশ্বাসঘাতক, অত্যাচারী ও অকৃতজ্ঞ।
ব্যক্তি হিসেবে: সাধারণ ব্যক্তি হিসেবে আলমনসুর ছিলেন একজন স্নেহশীল মানুষ। পিতা হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্নেহ বৎসল। এর প্রমাণ পাওয়া যায় পুত্রের জন্য আলাদা প্রাসাদ নির্মাণের বিষয়টি থেকে। এছাড়া একজন মুসলিম হিসেবে তিনি ছিলেন খাঁটি ধার্মিক ব্যক্তি। তাই ম্যুর বলেন, যদি আমরা তার চরিত্রকে বিশ্বাসঘাতকতা ও নিকৃষ্ট গুণটি ভুলে যায় তাহলে মনসুর সম্পর্কে আমাদের মূল্যায়ন ভিন্ন রূপ হবে।
শাসক হিসেবে: শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন নিষ্ঠুর ও বিশ্বাসঘাতক। আর এ কারণেই তিনি আব্বাসীয়দের ক্ষমতায় বসানো চাচা আব্দুল্লাহ, এমন কি আকৃত্রিম বন্ধু আবু মুসলিমকেও হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করেননি। ঐতিহাসিক ম্যুর বলেন, মনসুরের চরিত্রে উৎকৃষ্ট গুণাবলীর সমাবেশ থাকা সত্ত্বেও বিশ্বাসঘাতক এবং নিষ্ঠুর হিসেবে ইতিহাসের রায় তার বিপক্ষেই যাবে। আমির আলীর মতে নিষ্ঠুর স্বার্থপর এবং বিবেকহীন মনসুর কোন ব্যক্তিকে নিজের বা নিজের বংশের পক্ষে সামান্যতম বিপদজনক মনে করলে তার প্রাণনাশ না করে ছাড়তেন না।
খলিফা আবু জাফর আল মনসুরের বিদ্রোহ দমন ও শাসন সুদৃঢ়করণ
খলিফা আবু জাফর আল মনসুর সিংহাসন আরোহন করেgd তার চাচা জাবের যুদ্ধ বিজেতা আব্দুল্লাহ বিন আলীর রোসানলের সম্মুখীন হন। তিনি আবু মুসলিম খোরাসানীকে প্রেরণ করে আব্দুল্লাহকে নাসিবিনের যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী করেন। সাত বছর কারাবরণের পর আব্দুল্লাহকে একটি লবনের ভিত্তির ওপর নির্মিত প্রাসাদে স্থানান্তর করেন।
আকস্মিক বৃষ্টিপাতের প্রাসাদ টির ভিত্তি গলে যায় এবং প্রাসাদে ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে হতভাগ্যবন্দী আব্দুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মদিনা, কুফা ও বসোরাই মোঃ ও ইব্রাহিম এর অসংখ্য সমর্থককে হত্যা করেন। ইমাম হাসান (রা) ও ইমাম হুসাইন (রা) এর বংশধর এর সম্পত্তি বাজেট করা হয়। এমনকি ইমাম জাফর আর সাদিকের মতো ধার্মিক পুন্যাত্মার ওপর নির্যাতন চালানো হয়।
হানাফী মাযহাবের প্রবর্তক ইমাম আবু হানিফা ও মালেকি মাযহাবের প্রবর্তক ইমাম মালিক (রহ) কে কারারুদ্ধ করে চাবুক মারা হয়। বস্তুত আলী বংশীয় এবং তাদের সমর্থকদের দমনের নামে খলিফা আবু জাফর আল মনসুর যে নির্মম ও নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছিলেন তাকে ইতিহাসবিদগণ আবাসিক খিলাফতের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক ঘটনা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
খলিফা আবু জাফর আল মনসুরের কৃতিত্ব
খলিফা আবু জাফর আল মনসুর কে আব্বাসী বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়ে থাকে। তিনি তার রাজ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের পথ অবলম্বন করেন। আপনারা আর্টিকেলটি পড়ার মাধ্যমে খলিফা আবু জাফর আলমনসুরের বিভিন্ন ধরনের কৃতিত্ব সম্পর্কে জানতে পারবেন। নিচে তার কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
- রাজ্য বিস্তার: খলিফা আবু জাফর আল মনসুর অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনের পর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির জন্য ৭৫৯-৭৬০ খ্রিস্টাব্দে তার পুত্র মাহদিকে প্রেরণ করে তাবারিস্তান ও গীলান জয় করেন। এ অঞ্চল জয় করার পরই কাশিয়ান সাগরের পশ্চিম উত্তরে অবস্থিত বাইলামকে আব্বাসী সাম্রাজ্য ভুক্ত করেন এবং খালিদ বিন বার্মা কে এখানকার শাসক হিসেবে নিযুক্ত করে এশিয়া মাইনরে আব্বাসী শাসনের ভিত্তি দৃঢ় করেন।
- বাগদাদ নগরী প্রতিষ্ঠা: তিনি তার প্রশাসনিক কাঠামোকে সুবিন্যস্ত ও করার লক্ষ্যে ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে দামেস্ক থেকে বাগদাদের রাজধানী স্থানান্তর করেন। এ সময়ে দজলা নদীর পশ্চিম তীরে ৪৮ লক্ষ ৮৩ হাজার দিরহাম ব্যয় করে সুন্দর ও সুপরিকল্পিত এক নগরী প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ নতুন নগরীর নামকরণ করা হয়েছিল দার-আস সালাম।
- সেনাবাহিনী সুদৃঢ়করণ: সামাজিক শক্তি চেয়ে সাম্রাজ্যের মূল ভিত্তি- এ সত্যকে অনুধাবন করে আলমনসুর একটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শক্তিশালী নিয়মিত সেনাবাহিনী গঠন করেন। যার ফলে সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ভিত্তি সুদৃঢ় হয়।
- কুরআন-হাদিস সংরক্ষণ ও সংকলন: মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ব্যাখ্যা ও প্রাসঙ্গিক টিকা- টিপ্পনি অথবা তাফসীরের চর্চা এবং হাদীস অথবা মহানবী (স) এর বাণী সমূহ সংকলনের ব্যবস্থা করে অল মনসুর খ্যাতি অর্জন করেন। একই সাথে তিনি প্রাচীন কবিতা সমূহের সংরক্ষণের উদ্যোগ ও গ্রহণ করেন।
- স্থাপত্যশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা: আল-মনসারের আমলে পারস্য স্থপত্যের প্রভাবে আব্বাসী স্থাপত্য শিল্পের উন্মেষ ঘটে। ৭৬২-৬৪ খ্রিস্টাব্দে ৪৮,৮৩,০০০ দিরহাম ব্যয়ে সুরম্ম্য বাগদাদ নগরী নির্মাণ তারই ও অবিস্মরণীয় কীর্তি। এছাড়াও তিনি কারস-আল-খুলদ এবং রাজকুমার মাহাদির জন্য রুসাফা নামে আরও দুটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন।
- নতুন সভ্যতার জনক: খলিফা মনসুর ছিলেন একটি নতুন সভ্যতার জনক। তার খেলাফতে আরবিও, ভারতীয়, গ্রিক এবং ইরানি সভ্যতার সংমিশ্রণে যে নতুন সভ্যতা গড়ে ওঠে তা বিশ্ব্য সভ্যতার পূর্ণবিকাশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- সুন্নি মতবাদের পৃষ্ঠপোষকতা: আব্বাসীয় আন্দোলনে শিয়া মুসলিমগণ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু তাদের থেকে সিংহাসন নিরাপদ করার বসনায় আল মনসুর সুন্নী মতবাদকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। পি.কে. হিট্টি বলেন, মুয়াবিয়ার নীতিমালা যেভাবে উমাইয়াদের পথপ্রদর্শন করে ঠিক সেভাবে আল মনসুরের নীতি সমূহ অনেক যুগ ধরে তার বংশধরদের পরিচালিত করে।
- জনকল্যাণকর শাসন প্রতিষ্ঠা: একজন প্রজারঞ্জক শাসক হিসেবে আল মনসুর সাম্রাজ্যে বহু নগর, সরাইখানা, রাজপথ ও চিকিৎসালয় নির্মাণ করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষি কাজের উন্নয়নের জন্য তিনি নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা জনগণের জীবনে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে।
খলিফা আল মনসুর এর জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা
আল মনসুর জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক নিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বিভিন্ন সভ্যতার ও ভাষার গ্রন্থানাদি আরবি ভাষায় অনুবাদ করার জন্য তিনি একটি অনুবাদ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। মনসুরের পৃষ্ঠপোষকতায় ইবন মুকাফফাা সংস্কৃত হতে ফারসি ভাষায় অনূদিত কালিলা ও দিমনা নামক সর্বজনবিদিত পশু পক্ষীর গল্প আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন।
আল মনসুরের নির্দেশে ভারতীয় জ্যোতিষ্য শাস্ত্র খন্ডকা-খাদ্যকা এবং গল্প-পুস্তক হিতপদেশ আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। খলিফা আলম মনসুরের রাজত্বকালে গণিত শাস্ত্রের উৎকর্ষ বৃদ্ধি পায়। মনসুর নিজেও গণিত ও বিজ্ঞান শাস্ত্রের একজন সুপণ্ডিত ছিলেন। তার আমলে সংস্কৃত ভাষায় লিখিত ভারতীয় জ্যোতিবিদ্যার প্রভাবে সর্বপ্রথম আরব জ্যোতিষ বিষয়ক গ্রন্থ প্রণীত হতে থাকে।
তার পৃষ্ঠপোষকতায় আরব জ্যোতির্বিদ মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম আল ফারাজি সংস্কৃতিতে জ্যোতির্বিদ্যার ওপর লিখিত গ্রন্থ সিদ্ধান্ত আরবিতে অনুবাদ করে। বস্তুত মুনসুরের রাজ দরবারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতিষী ছিলেন ইবন মুকাফ্ফা।
তার পৃষ্ঠপোষকতায় ইবনে মুকাফ্ফা খুদাই নামা নামক পাহলভী ভাষায় লিখিত রূপকথা, ইতিহাস ও জীবনী সংবলিত পুস্তকটি সিয়ার আল-মূলক আল-আজম নামকরণ করে আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। খলিফা আলমনসুর এরিস্টোটল, ইউক্লিড, টলেমী প্রমখ গ্রিক দার্শনিক ও গণিতজ্ঞদের বিজ্ঞান গ্রন্থগুলো আরবি ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করেন।
লেখক এর মন্তব্য
প্রিয় পাঠক, আজকের এই আর্টিকেলে আপনারা খলিফা আবু জাফর আল মনসুর এর পরিচয় চরিত্র ও তার কৃতিত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। তাছাড়াও এখানে আমরা আবু জাফর আল মনসুর এর জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেছে। আজকের এই আর্টিকেলটি আপনাদের ভালো লেগে থাকলে অবশ্যই আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন।
এ ধরনের আরও নিত্য নতুন আর্টিকেল পড়ার জন্য আমাদের ওয়েবসাইটটি নিয়মিত ফলো করুন। কারণ আমরা এইখানে ইতিহাস বিষয়ক আরো বিভিন্ন ধরনের আর্টিকেল লিখে পাবলিশ করে থাকে। এতক্ষণ ধরে আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাদের জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url