খলিফা হারুন অর রশীদের (৭৮৬-৮০৯ খ্রি.) অভ্যন্তরীণ নীতি সম্পর্কে আলোচনা।
খলিফা হারুন অর রশীদের (৭৮৬-৮০৯ খ্রি.) অভ্যন্তরীণ নীতি সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। এছাড়াও এই আর্টিকেলে খলিফা হারুন অর রশিদের অভ্যন্তরীণ নীতির বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তুলে ধরা হবে। যেগুলো সম্পর্কে হয়তোবা আপনাদের অনেকেরই অজানা রয়েছে। এছাড়াও খলিফা হারুন অর রশিদের অভ্যন্তরীণ নীতিতে যে সকল বিদ্রোহ, জয়লাভ এবং শান্তিস্থাপন করেছেন সে সকল বিষয় সম্পর্কেও আলোচনা করা হবে।
এজন্য আপনারা আজকের এই আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার চেষ্টা করবেন। তা না হলে আপনারা এখানে থাকা বিভিন্ন বিষয়ে সম্পর্কে বুঝতে নাও পারেন। তাহলে চলুন আর দেরি না করে আজকের আর্টিকেলটি শুরু করা যাক।
ভূমিকা
খলিফা আল হাদীর মৃত্যুর পর ৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে হারুন দ্রুত বেগে বাগদাদে চলে আসেন। আলহাদির পুত্রকে কৌশলে বশীভূত করে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২৫ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহন করেন। সিংহাসনে আরোহন করেই তিনি রাজমাতা খায়জুরানকে সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা দিয়ে সম্মানিত করেন। খাইজুরাম ছিলেন ইয়াহিয়া বিন খালিদ বার্মাকির পৃষ্ঠপোষক।
তার প্রভাবে খলিফা হারুন অর রশিদ আল হাদি কর্তৃক বন্দিকৃত ইয়াহহিয়া বার্মাকিকে মুক্ত করেন। ইয়াহহিয়াকে তিনি প্রধান উজির হিসেবে নিযুক্ত করেন। ইয়াহহিয়ার দুই পুত্র ফজল ও জাফরও রাজদরবারে বিশেষ পদ লাভ করেন। হারানোর রশিদ অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন ও বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করে রাজ্যে সংহতি বৃদ্ধি করেন।
খলিফা হারুন অর রশিদের খারেজি বিদ্রোহ দমন
হারুনের রাজত্বের শুরুতেই খারেজিগণ যথারীতি বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ৭৮৭-৮৮ খ্রিস্টাব্দে খারেজিরা মেসোপটেমিয়ার শাসনকর্তা আবু হোরায়রাকে পরাজিত করে রাজধানী দখল করে নেই। খলিফা এক অভিযান প্রেরণ করে তাদেরকে দমন করেন। এই সময় অপর একটি বিদ্রোহ দেখা দেয় নাসী দিনের ওয়ালিদ বিন তারিকের নেতৃত্বে। বিদ্রোহীগণ আর্মেনিয়া, আজারবাইজান এবং মেসোপটেমিয়ার হুলওয়ান পর্যন্ত চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
এবারও খলিফার বাহিনী রাষ্ট্রদ্রোহী ওয়ালিদকে ৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে পরাজিত করে হত্যা করে বিদ্রোহ দমন করেন। ওয়ালিদের মৃত্যুর পর তার ভাগ্নি লায়লা মতান্তরে আল ফারিয়া খারেজিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি উপর্যুপরি কয়েকটি সংঘর্ষে খলিফার বাহিনীকে পরাজিত করেন। এজন্য তিনি “Arabian Joan of Ark” নামে পরিচিতি লাভ করেন।
তিনি সুন্দরী ও কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। পরবর্তীকালে তাকে রাজপথ থেকে বোঝানো হলে তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যান। এরপর খারেজিরা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। খারেজিরা পারস্যের হীরাত পর্যন্ত বিদ্রোহ ঘোষণা করলেও পারস্যের শাসনকর্তা আলী এবং ইশা এ বিদ্রোহ দমন করেন।
মধ্য এশিয়ায় শান্তি স্থাপন
খলিফা হারুন মধ্য এশিয়ায় দক্ষতার সাথে শাসন পরিচালনা করে শান্তি স্থাপন করেন। ৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র কাবুল ও কান্দাহার আব্বাসী শাসনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাম্রাজ্যের সীমা হিন্দুকুশ পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। খলিফা মধ্য এশিয়াকে সুসংহত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন: এশিয়া মাইনরের সীমান্ত অঞ্চলগুলোকে সাধারণ প্রদেশ থেকে পৃথক করে সুরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করেন।
এ অঞ্চলে তিনি একজন সামরিক শাসনকর্তা নিয়োগ করেন তার কাছে শাসনভার অর্পণ করেন। তিনি সিরিয়ার তারসাসে পুনরায় বসতে স্থাপন করে এই এলাকাকে একটি সুরক্ষিত দুর্গে পরিণত করেন।।
খলিফা হারুনুর রশিদের দাঁড়া আর্মেনিয়াজ খাজার বিদ্রোহ দমন
গ্রিকদের সাথে মিত্রতা সূত্রে আবদ্ধ অসভ্য খাজার উপজাতি গ্রীকদের প্ররোচনায় উত্তর দিক হতে আর্মেনিয়া আক্রমণ করে। তাদের দ্বারা সংগঠিত নিষ্ঠুর ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ছিল নজিরবিহীন। খলিফার দুজন শ্রেষ্ঠ নায়ক ৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে খলিফার আদেশে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করেন।
মুদারীয় ও হিমারীয় বিদ্রোহ দমন
রাসুল (সাঃ) এর সময়কাল থেকেই মুদারীয় ও হিমারীয় দ্বন্দ্ব চালু হয়। পরবর্তীতে এরই ধারাবাহিকতায় ৭৯২ খ্রিস্টাব্দে মুদারীয় এবং হিমারীয় গোত্রের মধ্যে সিরিয়া ও সিন্ধু প্রদেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। খলিফার আদেশে সেনাপতি মুসা বিন ইশা সিরিয়া এবং সেনাপতি দাউদ মুহাল্লাবী সিন্ধুতে বিদ্রোহ দমন করেন।
মসুলের বিদ্রোহ দমন
৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে আতার নামক এক ব্যক্তির নেতৃত্বে সকল মুশল খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে স্বয়ং খলিফা তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ পরিচালনা করে বিদ্রোহীদের দমন করেন এবং মসুলের প্রাচীর গুলো ভেঙে দিয়ে ভবিষ্যতে যাতে এরা বিদ্রোহ করতে না পারে সে ব্যবস্থা করেন।
খলিফা হারুন অর রশিদের আলি বংশীয়দের প্রতি নীতি
আস-সাফ্ফাহ ও আল-মনসুরের সময় নানাভাবে নির্যাতিত আলিপন্থীরা ন্যায় সঙ্গত কারণে খলিফা হারুন এর সময়ে বিদ্রোহ করেন। আল মনসুরের রাজত্বকালে আলী বংশীয় ইব্রাহিম ও মোহাম্মদকে অন্যায় ভাবে হত্যা করা হলে তাদের ভ্রাতা ইয়াহিয়া ৭৯১ খ্রিস্টাব্দে দাইলাম প্রদেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
খলিফা ইয়াহিয়াকে নিবৃত করার জন্য জুরজাহান ও পারস্যের শাসনকর্তা ফজল বার্মাকিকে প্রেরণ করেন। শিয়া মতাবলম্বী ফজল যুদ্ধের পরিবর্তে ইয়াহিয়াকে খলিফার সাথে মৈত্রী চুক্তি স্থাপন করতে বাধ্য করেন। কিন্তু সন্দেহপরায়ণ হারুন আলি বংশীয়দের হাতে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ইয়াহিয়াকে রাজধানীতে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদ্রোহের উৎস কে নির্মূল করার জন্য কারারুদ্ধ করেন।
একই লক্ষে তিনি যোগ শ্রেষ্ঠ তাপস আলী বংশীয় মুসা আল কাজিনকে বন্দী করে বাগদাদে অধ্যক্ষ সিন্দী ইবনে সাহিকের প্রহরাধীনে রাখেন। কয়েক বছর কারাবরণের পর তিনি ৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর পুত্র আলী আর রিজা আলী বংশীয়দের পরবর্তী ইমাম নিযুক্ত হন।
উত্তর আফ্রিকায় আগলাবীয় শাসন প্রতিষ্ঠা ও শান্তি স্থাপন
৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে খলিফা হারুন প্রখ্যাত সেনাধ্যক্ষ হায়সামাকে উত্তর আফ্রিকার শাসনকর্তা নিয়োগ করলে এখানে শান্তি ও সংহতি ফিরে আসে। এই সময়ে দক্ষিণ আলজেরিয়ার যাব অঞ্চলের শাসনকর্তা ইব্রাহিম ইবনে আগলাবকে বাৎসরিক চল্লিশ হাজার দিনার কর প্রদানের অঙ্গীকারে উক্ত প্রদেশের শাসনভার অর্পণ করা হয়।
মূলত হায়সামার পরামর্শেই খলিফা এটা করেছিলেন। ফলে উত্তর আফ্রিকায় স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। অন্যদিকে ইব্রাহিম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আগ্লাবি বংশ পরবর্তী ১০৯ বছর পর্যন্ত উত্তর আফ্রিকা শাসন করেন।
খলিফা হারুনুর অর রশিদ এর দ্বারা বার্মাকিদের ধ্বংস সাধন
দীর্ঘ ১৭ বছর পরমনিষ্ঠা, অবিচল আনুগত্য ও আত্মত্যাগ এবং অসামান্য কর্মনৈপুণ্যের সাথে শাসন কার্য পরিচালনা করে যারা হারুনের রাজত্ব গৌরব, মর্যাদা ও সমৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করেন তারা হলেন বিখ্যাত বার্মাকী উজিরগণ। কিন্তু ফজল বিন রাবির ব্যক্তিগত শত্রুতা ও, উচ্চাভিলাস, বার্মাকিদের অপরিসীম প্রভাব ও ঐশ্বর্য, উজির জাফরের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ঘটনার পর বার্মা কি জাফর হারানোর রশিদের বোন আব্বাসাকে গোপনে বিয়ে করলে এবং নানা সন্দেহ ও লোকজনের নানা রকম কথার প্রভাবে খলিফা হারুন বার্মাকিদের প্রতি খুবই ক্ষুব্ধ হন।
সৈয়দ আমির আলী বলেন,“ তিনি সন্দেহের অন্ধরোষ ও একক শাসন জনিত ক্রোধ বসে অবিরত অপবাদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে বহু পুরুষের বিশ্বস্ত সেবার কথা ভুলে গেলেন।“ খলিফা হঠাৎ এক রাতে মনসুর নামক তার এক নৈশ অনুচর দ্বারা জাফরের শিরশ্ছেদ করালেন। বৃদ্ধ ইয়াহিয়া, ফজল, মুসা ও মুহাম্মদ কে রাক্কায় কারারুদ্ধ করা হয়। তাদের সমুদয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।
৮০৬ খ্রিস্টাব্দে ইয়াহহিয়া এবং ৮০৯ খ্রিস্টাব্দে ফজল কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে তাদের প্রথম দেখে পি কে একটি বলেন, এভাবেই খালিদ বিন বার্মাকি স্থাপিত উজির পরিবারকে সমূলে বিনাশ করা হয়। মুসা ও মুহাম্মদ কে পরবর্তী খলিফা মুক্তি দান করেন।
শেষ কথা
প্রিয় পাঠক, আশা করি আজকের এই আর্টিকেলটি পড়ার মাধ্যমে আপনারা খলিফা হারুন অর রশীদের (৭৮৬-৮০৯ খ্রি.) অভ্যন্তরীণ নীতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ও বুঝতে পেরেছেন। আমরা আজকের এই আর্টিকেলে খলিফা হারুন ও রশিদের অভ্যন্তরীণ নীতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। যেগুলো আপনাদের ভালো লেগে থাকলে অবশ্যই আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন।
এ ধরনের আরও নিত্য নতুন আর্টিকেল পড়ার জন্য আমার এই ওয়েবসাইটটি নিয়মিত ফলো করুন এবং আমাদের সাথে থাকুন। আমরা এখানে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ক্যাটাগরির নতুন নতুন বাংলা আর্টিকেল লিখে পাবলিশ করে থাকে। এতক্ষণ ধরে আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাদের জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url